এক সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পার করেছে স্বর্ণযুগ। বাস্তবধর্মী ও সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে এ শিল্পটি মানুষের মননে
ও চিন্তায় প্রভাব ফেলেছিল দারুণভাবে।পাকিস্তানের কবলে থাকা বাংলায় তখন চলচ্চিত্র নির্মান করে সৃজনশীল নির্মাতারা বাংলা চলচ্চিত্রের প্রভাব তৈরী করেছেন। যা এ শিল্পকে বাংলায় বাঁচিয়ে রেখেছে অনেকদিন। ষাটের দশকে শুরু হওয়া এ সব চলচ্চিত্র নব্বই দশক পর্যন্ত ধরে রেখেছে তাদের ঐতিহ্য।
১৯৫৬ সালে তৈরী হয় বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ। ষাটের দশকে আবু হামিদ সালাহ্উদ্দিন যে নদী মরূপথে (১৯৬১), সূর্যস্নান (১৯৬২) ও ধারাপাতসহ (১৯৬৩) বিভিন্ন সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। যা বাংলার আবহমান কালের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন। ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ এ সব সিনেমা দেখতে ভিড় করেন পেক্ষাগৃহে। বিশেষ করে সে সময় নির্মিত হয় রুপবান সিনেমা। এ সিনেমাটি তখন দেখতে প্রেক্ষাগৃহে মানুষের ভিড় লেগে যায়। সে সময় সিনেমা নির্মান করেন জহির রায়হান,খান আতাউর রহমান, চাষী নজরুল ইসলামসহ অনেকে। জহির রায়হানের কখনো আসেনি(১৯৬১), কাচের দেয়াল (১৯৬৩), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১) ও এ স্টেট ইজ বর্ন (১৯৭১) চলচ্চিত্র এই সময়ের উজ্জ্বল সৃষ্টি।
এছাড়া খান আতাউর রহমান পরিচালিত রাজ সন্ন্যাসী, আবার তোরা মানুষ হ, সুজন সখী, দিন যায় কথা থাকে, ছুটির ঘণ্টা (১৯৮০), এখনও অনেক রাত প্রভৃতি চলচ্চিত্র বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। স্বাধীনতার পরে আবির্ভূত চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে আলমগীর কবির (১৯৩৮-১৯৮৯) উল্লেখযোগ্য। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র হলো ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), সূর্য কন্যা (১৯৭৬), সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭), রূপালী সৈকতে (১৯৭৯), মোহনা (১৯৮২),পরিণীতা (১৯৮৪) ও মহানায়ক (১৯৮৫)বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশেষ মানে উন্নীত করে।
বিংশ শতাব্দীতে এসে মোরশেদুল ইসলাম ও তারেক মাসুদসহ অনেকে বেশকিছু ভাল চলচ্চিত্র নির্মান করলেও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে নকলের দৌড়াতœ ও প্রযুক্তির যাচ্ছেতাই ব্যবহারে সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষ। হলবিমুখ হচ্ছে দর্শক। যেন বিশেষ এক শ্রেণীর দর্শকের জন্যই নির্মান হচ্ছে সিনেমা। এ অবস্থায় এখন চলচ্চিত্র সংকটাপন্ন অবস্থা বিরাজ করছে বলে মনে করছেন চলচ্চিত্র বোদ্ধারা।চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগশেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই।এখন চলচ্চিত্রে মন্দাভাব চলছে বলে মনে করছেন অনেকে।
বর্তমানে চলচ্চিত্রের প্রতি মধ্যবিত্ত ও রুচিসম্পন্ন মানুষের আস্থা উঠে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তারা এখন প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখে সময় নষ্ট করতে চাননা। এর ফলে ধ্বস নেমেছে চলচ্চিত্র ব্যবসায়ও। এখন আর তাই অনেকেই সিনেমা নির্মানেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এর কিছু সংকট রয়েছে। যা রুচিশীল মানুষকে এ শিল্প থেকে দুরে সরিয়ে রাখছে।
বর্তমানে প্রধান ও প্রথম সংকট হচ্ছে সিনেমা হলের সংখ্যা ও দর্শক সংখ্যা হ্রাস পাওয়া। আর এর প্রধান কারণ হচ্ছে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল-ডিভিডি-ইন্টারনেট-কম্পিউটার-ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনের সেটের মাধ্যমে চলচ্চিত্র ও টিভি অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ তৈরী হওয়া।
এর আরও কারণের মধ্যে রয়েছে পুঁজির অভাব, চলচ্চিত্র নির্মাণে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তার প্রভাব। চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যয় বৃদ্ধি, সেই তুলনায় আয় কম। সিনেমা হলের পরিবেশে দর্শকবান্ধব সুযোগ-সুবিধার অভাব প্রদর্শনে আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাব।মৌলিক কাহিনী ও বিষয়বস্তুর অভাব।
এছাড়াও যে সংকট বেশী করে ঘনীভূত হচ্ছে বাংলা সিনেমার। তা হলো অশ্লীল-যৌনতা-প্রতিহিংসা-সংঘাত-অপরাধমূলক উপাদানে ভরা উদ্ভট, অবাস্তব নকল ও বৈচিত্র্যহীন কাহিনীর আধিক্য, মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির ভিডিও দস্যুতা, বিদেশী ও অন্যান্য ভিডিও চিত্রের অবাধ ও সুলভে বিক্রি।
এছাড়া সেন্সর বোর্ড কর্তৃক ব্যতীত দৃশ্যের পুনঃসংযোজন ও অশ্লীল কার্ট পিস সংযোজনপূর্বক অসাধুপন্থায় সিনেমা হলে প্রদর্শন করা, প্রযোজক ও নির্মাতাদের সৃজনশীল-মননশীল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও দেশপ্রেম বোধের অভাব।পরিচালক-পাত্র-পাত্রী ও কুশলীদের প্রশিক্ষণের অভাবও একটি সংকট হিসেবেআর্বিভূত হয়।
এ থেকে উত্তরণের উপায় যার মাধ্যমে করা সম্ভব তা হলো-চলচ্চিত্রের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নির্মাণ ব্যয় হ্রাস করতে হবে। এ উদ্দেশে এফসিডি, ডিএফপির আধুনিকায়ন করতে হবে।সিনেমা হলগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে আধুনিকায়ন করতে হবে। হলগুলোর পরিবেশ উন্নত করতে হবে। সিনেমা হলগুলোর আধুনিকায়ন ও সংস্কারের জন্য ব্যাংক বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ/অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রযোজনায় পুঁজির জোগান বাড়াতে হবে। এ উদ্দেশে শিল্প হিসেবে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। বেসরকারি শিল্পগোষ্ঠী, বহুজাতিক কোম্পানি ও অন্যান্য বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে চলচ্চিত্রে পুঁজি বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে।
চলচ্চিত্র পরিচালক-শিল্পী-কুশলীদের প্রশিক্ষণের জন্য ফিল্ম ইন্সটিটিউট স্থাপন করতে হবে। চলচ্চিত্র বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হবে।বছরে অন্তত পাঁচটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অনুদান প্রদান করা। প্রতিটি চলচ্চিত্রে অনুদানের পরিমাণ হবে ৫০ থেকে ৮০ লাখ টাকা। প্রবীণ ও পরীক্ষিত নির্মাতারা এ অনুদান পাবে।
বছরে পাঁচটি স্বল্পদৈর্ঘ্য, পাঁচটি শিশু-কিশোরতোষ এবং পাঁচটি প্রামাণ্যচিত্রে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা অনুদান প্রদান করা। এ অনুদান নবীন ও তরুণ নির্মাতাদের দেয়া হবে।নিয়মিতভাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান ও পুরস্কারের অর্থের পরিমাণ বাড়ানো।সুস্থ, শিল্পশোভন ও শিশু-কিশোরতোষ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে প্রমোদকর হ্রাস করা।সেন্সরবিধির আধুনিকায়ন ও চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠন করা।
অশ্লীল ও নকল ছবির ছাড়পত্র না দেয়া। আইনভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।ভিডিও দস্যুতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
দেশে নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব-মেলা-প্রদর্শনীর আয়োজন করা এবং বিদেশী উৎসব ও মেলায় নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করা। এজন্য আলাদা দফতর গঠন করা।ফিল্ম আর্কাইভের ভবন নির্মাণে, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম ও ডিজিটাল কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা। এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও জনবলের ব্যবস্থা করা।
চলচ্চিত্র সংসদের কার্যক্রম সচলকরণ ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ।চলচ্চিত্র দর্শকদের রুচি, জ্ঞানবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি উন্নতকরণ এবং তাদের ভালো ছবি দেখা ও পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্বুদ্ধ করা।চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন। টেলিভিশনে রুচিশীল এবং সৃজনশীল চলচ্চিত্র, গান, নাচ প্রদর্শন করা।সংস্কৃতি ও পণ্যবিনিময় চুক্তির অধীনে চলচ্চিত্র আমদানি ও রফতানি করা।
তথ্যসূত্র : গবেষক অনপুম হায়াৎ
তথ্যসূত্র : গবেষক অনপুম হায়াৎ
Comments