চলচ্চিত্রের উপেক্ষিত নেপথ্য নায়ক হীরালাল সেন

রোমান কবির:
১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর পৃথিবীতে হয়ে যায় এক বিপ্লব। ফ্রান্সের প্যারিসে লুই লুমিয়ের ও অগাস্ত লুমিয়ের নামের দুই ভাই প্রবর্তন করেন চলচ্চিত্রের।  তাদের চলচ্চিত্র নির্মাণের পরপরই বিশ্বের অনেকে দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়।
লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় দেশে দেশে চলচ্চিত্র প্রদর্শণ করেন।  তাদের প্রতিনিধিরা এ ভারতীয় উপমহাদেশে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন ১৯০০ সালের গোড়ার দিকেই। তাদের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে উপমহাদেশের অনেকেই চলচ্চিত্র প্রদর্শণ শুরু করেন। তবে সবার আগে এ দেশে চলচ্চিত্র প্রদর্শণ শুরু করেন বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার বগজুড়ি গ্রামের হীরাালাল সেন। তিনিই এ উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার। তাকে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক বলা হয়। তিনিই একাধারে ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম বাঙালি চলচ্চিত্র প্রদর্শক, চিত্রপ্রদর্শনের মালিক, চিত্রপরিচালক, প্রযোজক, ক্যামেরাম্যান, সংগঠক, চিত্রকর্মীদের শিক্ষক। তবে তার সেসময়কার নির্মিত চলচ্চিত্র নিদর্শন সব পুড়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁর অবদান ও কীর্তির কথা সমকালীন পত্রপত্রিকা ও স্মৃতিকথায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। কিন্তু চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে তিনি ছিলেন সবসময়ই উপেক্ষিত। তাকে কেউ মনে রাখেনি। এ প্রজন্মের অনেকেই তাকে চিনেনা। 

হীরালাল সেনের জন্ম ১৮৬৬ সালে মানিকগঞ্জের বগজুরি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম চন্দ্রমোহন সেন ও দাদার নাম গোকুল কৃষ্ণ সেন। তাঁরা জমিদার ও আইনজীবী ছিলেন। ঢাকার জিন্দাবাহার লেনে তাঁদের বাড়ি ছিল। হীরালাল সেনের লেখাপড়া শুরু হয় স্থানীয়ভাবে। পরে তিনি ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে পড়েন। তাঁর সঙ্গে ঢাকায় পড়তেন ফুফাতো ভাই দীনেশ চন্দ্র সেনও (লোকসাহিত্য বিশারদ)। পরে হীরালাল সেন পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে যান এবং ওখানেই কলেজে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায়ই হীরালাল সেন ফটোগ্রাফি চর্চার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ১৮৯০ সালের মধ্যে মানিকগঞ্জ ও কলকাতায় ফটোগ্রাফিক স্টুডিও খোলেন। এগুলোর মধ্যে ছিল ‘অমরাবতী ফটো আর্টস অ্যাসোসিয়েশন ও ‘এইচ এল সেন অ্যান্ড ব্রাদার্স।  এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁর ছোট ভাই মতিলাল সেন ও দেবকীলাল সেন। হীরালাল ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৮ সালের মধ্যে ফটোগ্রাফি চর্চায় শ্রেষ্ঠত্বের জন্য সাতবার স্বর্ণপদক লাভ করেন।তিনি ১৯১৭ সালের এ তারিখে মৃত্যুবরণ করেনা।
তিনি প্রথমে ছিলেন একজন আলোকচিত্রী। হীরালাল সেন যখন আলোকচিত্র চর্চা নিয়ে মেতেছিলেন তখন ফ্রান্স ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশে।চলচ্চিত্র চালু হয় লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের মাধ্যমে। মাস ছয়েকের মধ্যেই মুম্বাইয়ের হোটেল ওয়াটসনে চলচ্চিত্র দেখানো হয় ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই।  নতুন এই আকর্ষণীয় মাধ্যম উপমহাদেশে হৈ চৈ ফেলে দেয়।  অল্প সময়ের মধ্যেই তা কলকাতা, লাহোর, মাদ্রাজ এবং ঢাকায়ও দেখানো হয়।
কলকাতায় ১৮৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে টমাস হাডসন ও আর্থার সুলিভান এবং পরের বছর স্টিভেনশন চলচ্চিত্র দেখান।  হীরালাল তখন এই চলচ্চিত্র বা বায়োস্কোপ দেখে অভিভূত হন এবং নিজে তা প্রদর্শন ও নির্মাণের ব্যাপারে আগ্রহী ও উদ্যোগী হন।  তিনি স্টিভেনশন ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক ফাদার ল্যাফোঁর সহায়তায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করেন এবং পরে বিদেশ থেকে প্রজেক্টর ও চলচ্চিত্র আমদানি করে তা দেখাতে শুরু করেন।  প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি অমর দত্তের সহায়তায় ক্লাসিক থিয়েটার ও মিনার্ভা থিয়েটার, ভোলার এসডিওর বাংলো এবং নিজগ্রাম বগজুরীর বাড়িতে চলচ্চিত্র দেখান।  পরবর্তীকালে তিনি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য ‘দি রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানি গঠন করেন ১৯০০ সালের মধ্যে।  এর মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন স্থানে বায়োস্কোপ দেখান।  চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে গিয়ে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতি আগ্রহী হন।  তিনি স্টিভেনশনের সঙ্গে থেকে মুভি ক্যামেরার কাজ শেখেন এবং পরবর্তীকালে ফ্রান্স থেকে কলকাতায় আগত চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান প্যাথে কোম্পানির সঙ্গে থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের বিভিন্ন কারিগরি কৌশল সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন।
১৯০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি লন্ডন থেকে মুভি ক্যামেরা আমদানি করে প্রথমে মানিকগঞ্জের গ্রামে শুটিং করেন এবং ‘পুকুরে স্নান ও ‘কোটের খেলা নামে দুটি স্বল্পদৈঘ্য চিত্র নির্মাণ করেন।  এগুলো কলকাতায় দেখানো হয়।  এভাবে শুরু হয় হীরালাল সেনের চলচ্চিত্র নির্মাণ, পরিকল্পনা ও প্রযোজনার অভিযাত্রা।  ১৯০১ সালে তিনি কয়েকটি জাতীয় নাটকের নির্বাচিত মঞ্চদৃশ্যের চিত্র ধারণ করেন।  এটি ৯ ফেব্রুয়ারি ক্লাসিক থিয়েটারে প্রদর্শিত হয়।  এ সব চিত্রের মধ্যে ছিল আলীবাবা, হরিরাজ, দোললীলা, সরলা, বুদ্ধচরিত, সীতারাম ও ভ্রমর।
এ ছাড়া হীরালাল সেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান, চলমান জনজীবন, রাস্তাঘাট, মেলা, প্রাকৃতিক জীবন, রাজনৈতিক ঘটনা ও আন্দোলন, সম্রাটের অভিষেক, দরবার, শব মিছিল, বিজ্ঞাপন, স্বনির্বাচিত বিষয়বস্তু নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।  সমকালীন চলচ্চিত্রের ইতিহাসে হীরালাল সেন দিল্লির দরবার ১৯০৩ ও ১৯১১, বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৫), বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৫), পূর্ণাঙ্গ নাটক আলীবাবা (১৯০৪), লোকমান্য তিলক (১৯০৬), চিত্র নির্মাণ করে নতুন অধ্যায় সংযোজন করেন।  এ ছাড়া তিনি বঙ্কিম-রবীন্দ্র-গিরিজা-শরৎ কাহিনী নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্র নির্মাণ করেন।  জানা যায়, ‘আলীবাবা (১৯১৩) নাটকটিতে তিনি রং ব্যবহার করেছিলেন।  তিনি প্রথম বিজ্ঞাপনচিত্রও তৈরি করেন।  ১৮৯৮-১৯১৩ ছিল হীরালাল সেনের সুবর্ণ সময়।  পরবর্তীকালে তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেন ভাই মতিলাল সেন, ভাগ্নে কুমার গুপ্তসহ অন্যরা। নায়িকা কুসুম কুমারীর সঙ্গে এক মামলায়ও জড়িয়ে পড়েন তিনি।  মানসিক কষ্ট, অর্থকষ্ট এবং শারীরিক কষ্টে তাঁর জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
ভাই মতিলাল সেন তাঁর সব চিত্রের মালিকানা এবং কোম্পানির মালিকানা হস্তগত করে নেন।  তাঁর তোলা সব চিত্র মতিলাল সেনের গুদামে আগুন লেগে পুড়ে যায়।  সেই সঙ্গে পুড়ে মারা যায় তাঁর মেয়ে অমিয়বালাও।  হীরালাল সেন সিনেমা বানাতে গিয়েও একজনের সঙ্গে প্রতারণার শিকার হন।  সর্বস্বান্ত হয়ে তিনি তাঁর ক্যামেরা বন্ধক রেখে অর্থ সংগ্রহ করেন। এমন দুরবস্থায় তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১৯১৭ সালের ২৯ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।  মৃত্যুর সময় তাঁর শয্যাপাশে ছিলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর মৃত্যুতে শোকবার্তা প্রেরণসহ অর্থসহায়তা করেছিলেন পরিবারকে।

তথ্যসূত্র:চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ

Comments