‘অনেক দামে কেনা’- নকলের ভিড়ে এক ভিন্ন প্রয়াস

রোমান কবির 
তামিলনাড়ু, তেলেগু, বলিউড আর ঢালিউডের হুবহু নকল করে তৈরী হচ্ছে একের পর এক সিনেমা। একটা আইটেম সং, দুইটা গান, অবাস্তব কাহিনী আর সমাজের আকাঙ্খার বিপরীতে সিনেমা উপহার দিচ্ছে আমাদের এ সময়ের কিছু নির্মাতা। এ নকলের মহোৎসবে সৃজনশীল মানসিকতার দর্শক হারাচ্ছে হলগুলো। মানহীনতার দণ্ডে দণ্ডিত হচ্ছে একের পর এক সিনেমা।
এর মধ্যেও কিছু মানসম্মত মৌলিক সিনেমা নির্মিত হয়েছে তবে তা হাতেগোনা। কিন্তু এর মধ্যে বেশিরভাগই  বাণিজ্যিক সফলতা পায়নি। এমন সময়ে পুরোপুরি বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রযোজনায় অনেক দামে কেনা হলগুলোতে মুক্তি পেয়েছে গত ৮ এপ্রিল শুক্রবার। চলছে দেশের ৯০টির বেশী হলে। যখন বানিজ্যিক সিনেমা বলতে যৌথ প্রযোজনার ছবির নামে অখাদ্য, কুখাদ্য ও নকলের ভাজাপোঁড়া আমাদের দর্শকদের খাওয়ানো হচ্ছিল সেইে সময় জাকির হোসেন রাজুর চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় একটি নির্মল ঝরঝরে সিনেমাই দেখলাম মনে হচ্ছে। তার নির্মাণশৈলী বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আসলেই চমৎকার। এ সিনেমা নিয়ে অনেকেই অনেক নেতিবাচক কথাই বলেছেন। কিন্তু ছবিটিতে নেতিবাচক বলে মনে হয়নি আমার। কিন্তু কিছু ভুল তো থাকবেই।
তবে এ সিনেমা দেখে তেমন খারাপ আমার লাগেনি। মনে হয়েছে নির্মল ও ঝরঝরে। এ সিনেমা পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে দেখার মতো একটি ছবি। এর নির্মাণশৈলী, ক্যামেরার ব্যবহার ও সম্পাদনা মানসম্মতই মনে হয়েছে। বিশেষ করে এক জায়গায় এর জাম্প কাটের ব্যবহার চমৎকার। যেখানে ম্যাচ কাট করা যেত সেখানে খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে জাম্পকাট ব্যবহার করা হয়েছে। তবে গল্প বলার ঢং কিছুটা দুর্বল লেগেছে। এর ঘাটতি পূরণ করেছে শক্তিশালী সংলাপ। কমেডি, রোমান্টিকতা আর নায়কের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের শটগুলো ভালো লেগেছে। কিন্তু নায়ক বাপ্পির অভিনয় আরও সাবলীল ও প্রানোজ্জল হওয়া জরুরী বলে মনে হয়েছে। মাহির অভিনয় আগের তুলনায় আরও ম্যাচিউর মনে হয়েছে। একজন অন্ধ ফুলওয়ালী হিসেবে নতুন চরিত্র সৃষ্টি করেছেন মাহি। যা তার দর্শকদের আনন্দ দিয়েছে। ডিপজলের হাস্যরসাতœক সংলাপ হলের দর্শকদের সুস্থ বিনোদনে সহায়ক হয়েছে। শিল্প নির্দেশনা ও কস্টিউম ডিজাইন খুবই পরিপাটি। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন একজন ফুল বিক্রি করা মেয়ের এতো সুন্দর জামা কাপড় আর তার সুন্দর মেকাপ কেন। যে কিনা তিন মাসের বাড়ি ভাড়াই দিতে পারেনা। এ কথার যুক্তি হচ্ছে সিনেমায় দেখানোই হয়েছে যে মাহিকে ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছে। তখন ঘটকের সংলাপ থেকে বোঝা গেছে মাহি একটি অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের মেয়ে ছিলো। কিন্তু অভাবে পড়ে ফুল বিক্রি করছেন। এতেই বোঝা যায় তার বাবা-মা বেচে থাকতে মাহি অবস্থাসম্পন্নই ছিলেন। কিন্তু অভাবে পড়ে ফুল বিক্রি করছেন। একটি অবস্থাসম্পন্ন ঘরের মেয়ের দু-একটি ভালো জামা-কাপড় থাকতেই পারে। সেটা পড়ে তিনি ফুল বিক্রি করতে গেছেন। আরেকটি জিনিষ আমার মনে হয়েছে তার হাতের ফুল আর তার পোশাক এক দারুন কম্পোজিশন তৈরী করে। যা বাস্তবভিত্তিক ও যথোপযুক্ত। এদিকে মাহির মেকাপ কিন্তু খুব বেশী গরজিয়াস ছিলোনা। প্রধান চরিত্র হিসেবে তার পোশাক নির্বাচন ও মেকাপ খুব সচেতনভাবেই করা হয়েছে। সাউন্ডের ব্যবহারও  মোটামুটি চমৎকার বলা যায়।
চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র সিটি লাইটের ছায়া অবলম্বনে সিনেমাটি তৈরী করা হয়েছে। অনেকেই বলছেন কই আগর তলা আর কই চকির তলা। তা ঠিক চার্লি চ্যাপলিনের সিটি লাইটের সঙ্গে এর তুলনা চলেনা। তবে এ সময়ের এ দেশের প্রেক্ষাপটে এটি যথার্থই। আর সিটি লাইট একটি বিদেশী নির্বাক ছবি। আর এটি একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্মিত সবাক চলচ্চিত্র।
সবকিছু মিলিয়ে ছবিটির নির্মাণশৈলী নির্মাতার মেধার বহিপ্রকাশ বলে মনে হয়েছে। জাকির হোসেন রাজু তার মেধার যথেষ্ট ব্যবহার করেছেন। এটি নকলের ভিড়ে একটি ভিন্ন প্রয়াস বলে আমার মনে হয়েছে। তার এ পথপরিক্রমায় অন্যরাও হাঁটতে পারেন। তবে কপি-পেষ্ট নির্মার্তাদের রাজুর কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। এ সময়ের যারা তরুণ নির্মাতা বা চলচ্চিত্র নিয়ে পড়ছেন তাদেরও শেখার আছে। চলচ্চিত্রের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি এ থেকে শিখেছি অনেক।

Comments